অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম যেই সাইকেল গুলো আমি চালাই সেগুলো নিয়ে রিভিউ লিখলে মন্দ হয়না। নতুন রা সবসময়ই বাইকের ব্যাপারে জানতে চান, তাদের কে ইনবক্সে বা সামনা সামনি যতটুক পরামর্শ দেবার দেই, তবে বাইকের রিভিউ লিখে রাখলে সবার জন্যই সুবিধা। যাইহোক, এটা আমার প্রথম বাইক রিভিউ “সারাসেন টাফট্র্যাক্স ম্যানস ” বাইক নিয়ে।
ব্র্যান্ড – সারাসেন (Saracen)
অরিজিন – যুক্তরাজ্য
মডেল – টাফট্র্যাক্স ম্যানস
ফ্রেম-
আমার উচ্চতা অনুযায়ী ইন্টারন্যাশনাল রেকমেন্ডেশন হল ১৬ – ১৬.৫ ইঞ্চি। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল ঢাকায় এই সাইজের কোন বাইক পাওয়া যায়না বিধায় আমি ১৭” ফ্রেমের বাইক চালাই। তবে মজার ব্যাপার হল সারাসেন টাফট্র্যাক্স ম্যানস এর ১৮” ফ্রেম বিগত ৬-৭ মাস ধরে চালাচ্ছি !!!
১৮” তেও আমার কোন সমস্যা না হবার প্রধান কারন এর টপ টিউব লেন্থ। ১৮” ফ্রেমে এর টপ টিউব লেন্থ ৫৯৫ মিলি মিটার, আর টপ টিউব রিচ ৪২৬ মিলিমিটার। আর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এর স্টক স্টেম। স্টেম টি মাত্র ৬০ মিলি মিটার।
শর্ট স্টেম হওয়াতে স্যাডেল থেকে হ্যান্ডেল বার পর্যন্ত দূরত্ব আমার জন্য আরামদায়ক, যদিও ফ্রেম আমার উচ্চতা অনুযায়ী বড়।
৬০৬১ সিরিজের এলয় টিউবিং এর ফ্রেম টি এই পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধকল সহ্য করে টিকে আছে। এই বাইক দিয়ে আমি প্রায় ৫-৬ টা লং ডিসটেন্স রাইড দিয়েছি ঢাকার বাইরে। ফ্রেমের গায়ে অসংখ্য স্ক্র্যাচ পড়েছে ট্রাকে আনা-নেওয়া র কারনে কিন্তু স্ট্রং বিল্ড কোয়ালিটি এবং হালকা ওজন এই প্রাইজ রেঞ্জের এই বাইকে একটি প্রধান গুন। কয়েক শত মাইল অফ রোড সারভাইভ ও করেছে সারাসেন টাফট্র্যাক্স ম্যানস।
ড্রাইভট্রেইন –
একদম বেসিক শিমানো ড্রাইভট্রেইন ব্যাবহার করা হয়েছে এই মডেলে। ফ্রন্ট ডিরেইলার টি এক্স ৫১ এবং রেয়ার ডিরেইলার টি এক্স ৩৫ (সেভেন স্পীড)। যেকোন রেগুলার রাইডার এই ড্রাইভট্রেন দেখে নাক সিটকাতে পারেন, খুব স্বাভাবিক, কিন্তু মজার ব্যাপার হল গত ৬-৭ মাসে এই বাইক দিয়ে ২৫০০ + কিমি চালানর পরেও আমার এখন পর্যন্ত গিয়ার টিউন করার দরকার হয়নি। এত স্মুথ শিফটিং আমি এসেরা, এলিভিও, ডিওরেও পাইনি। কথাটা হাস্যকার শোনালেও সত্য। আমার চালানো এবং মেইন্টেনেন্সের উপরে আসলে এর পারফরম্যান্স নির্ভর করবে। আমি দুই মাসে একবার অন্তত গিয়ার ও ব্রেক কেবল গ্রিজিং করি। সেকারনে ও এটা হতে পারে। তবে ওভারল টি এক্স গ্রুপ সেট থেকে প্রাপ্ত পারফরম্যান্স এ আমি মুগ্ধ। শিমানো ই এফ ৫১ সেভেন স্পিড শিফটার / লিভার নিয়ে বলার কিছু নাই, এক কথায় “অক্ষয়”।
ক্র্যাঙ্ক –
এই বাইকের বেস্ট পার্ট এর একটি হল চেইনসেট / ক্র্যাঙ্কসেট – Suntour XCC-T102 28/38/48T
সাধারণত বেশিরভাগ মাউন্টেনবাইকে সবচেয়ে বড় কগে ৪৬ টি দাঁত ব্যাবহার করা হয়। সারাসেন টাফট্র্যাক্স ম্যানসে ৪৮ টি দাঁত দেয়া হয়েছে। এই বাড়তি ২ টি দাঁত আপনাকে বাড়তি গতি ও দিচ্ছে। আমি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি এই বাড়তি দুই দাঁতের সুবিধা। যখন একটু জোরে চালানোর প্রয়োজন পরে তখন সামনের গিয়ার তিন নাম্বারে তুলে সেই একটা টান পাওয়া যায় 😀
হাব –
কে টি এলয় ৩৬ হোল হাব এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা ছাড়াই চলছে। তবে খুব ইম্প্রেসিভ কিছু নয়। দামি হাবের সেই টিক টিক আওয়াজ এটায় কম, এই দামে এর থেকে আর কি আশা করেন?
ব্রেক –
টেকট্র এলয় ভি-ব্রেক যদি আপনি ফাইন টিউন করে রাখেন তবে এটি প্রোম্যাক্স ও টেকট্র ম্যাকানিকাল ডিস্ক ব্রেকের থেকেও বেটার ব্রেকিং পাওয়ার দিবে। এই ভি ব্রেকের স্টপিং পাওয়ার যেকোন রাইডের জন্য যথেষ্ট। এমনকি আপনি যদি বান্দারবানের হাইওয়ে তেও চালাতে চান নির্দ্বিধায় ডাউনহিল চালাতে পারবেন। যথেষ্ট ভাল ব্রেক। আমি যেহেতু প্রচুর টুরিং করি সুতরাং ভি ব্রেক ঢাকার বাইরে টুরিং এর জন্য সুবিধাজনক এই কারনে ব্রেকের কোন সমস্যা হলে আপনি যেকোন রিকশা / ভ্যান মেকানিকের কাছ থেকে সারিয়ে নিতে পারছেন যেটা ঢাকার বাইরে বিশাল হেল্প।
টায়ার –
এই বাইকের বেস্ট পার্টের আরেকটা হল এর স্টক টায়ার। WTB Nano 26 x 2.1
এই রেঞ্জের বাইকে এরকম একটি দামি টায়ার আসলে বাড়তি পাওনা। ২৫০০ + কিমি চালানোর পরেও এখন পর্যন্ত আমার টায়ারের প্রতিটি বিট অক্ষত। গত ৬-৭ মাসে মাত্র দুটি লিক হয়েছে। তাও ঢাকার বাইরে লং ট্যুরে। বালুর উপরে দিয়ে আরামসে চালিয়ে দেয়া যায় স্কিড করে খুব কম। রোলিং ভাল, আবার সেমি অফ রোড গ্রিপ ও আছে, তবে এফ রোডের জন্য খুব বেশি আরামদায়ক বা সুবিধাজনক নয়। কমিউটিং ও টুরিং এর জন্য ২৬ x ২.১ হিসেবে যথেষ্ট আরামদায়ক টায়ার। স্লিক টায়ারের দরকার হবেনা।
হ্যান্ডেল্বার –
৬২০ মিলি মিটারের এই স্টিল হ্যান্ডেল্বার টি আমার ভাল লাগেনি। আমি চওড়া হ্যান্ডেলবারে অভ্যস্ত। যাদের ৬২০ মিমি নিয়ে সমস্যা নেই তারা স্টক হ্যান্ডেল্বার ব্যাবহার করতে পারেন। আমি স্টক হ্যান্ডেল্বার চেঞ্জ করে ট্রুভাটিভ স্টাইলও ৬৮০ মিমি লাগিয়ে নিয়েছি, এতে করে আমাকে আরো বেশি কন্ট্রোল এবং কমফোরট দিচ্ছে হ্যান্ডেলবার।
স্যাডেল –
স্টক স্যাডেল টি বেশ আরামদায়ক। একদম নরম নয় একদম শক্ত নয়, মাঝামাঝি। শেইপ টাও লং রাইডের জন্য উপযুক্ত। প্রথম কিছুদিন হয়ত ভাল লাগবেনা, তবে আমার পরামর্শ হবে ১-২ মাস কষ্ট করে চালানোর পরে দেখবেন এই স্যাডেল ছাড়া অন্য স্যাডেলে বসতে চাবেন না।
সাস্পেনশন –
সান্তুর এক্স সি টি ৮০ এম এম। ইদানীং কালের ছেলেপেলেদের দেখি ১২০ এম এম ছাড়া কোন ফরক ভাল লাগে না 😛 তবে এই ৮০ এম এম খারাপ নয়। লো বাজেট বাইক হিসেবে এই সাস্পেনশন ১০ এ ৮। তবে আমি ৪-৫ মাস চালানোর পরে স্টক সাস্পেনশন আপগ্রেড করে এক্স সি এম ১২০ এম এম লাগিয়েছি (ভেলোস লিগাসি’র স্টক ফরক)। যা আমাকে বাড়তি আরাম দেয়।
বটম ব্রাকেট –
থুন ব্র্যান্ডের সিল কার্টিজ বিবি এখন পর্যন্ত কোন কট কট মট মট শব্দ করেনি। সুপার চলছে।
পেইন্ট জব –
সাইকেল লাইফ এক্সক্লুসিভের যত বাইক পাওয়া যায় তাদের মধ্যে সারাসেনের ডিকেলস সবচেয়ে ভাল। পেইন্ট জব ও খুব সুন্দর, ব্যাক্তিগত ভাবে আমার সিম্পল ডিকেলস পছন্দ, কালো ও সাদার কন্ট্রাস্টে এই মডেলের পেইন্ট জব আমার কাছে ১০ এ ৯।
লেডিস ভার্সন-
এই মডেলের একটি লেডিস ভার্সন ও আছে, সব এক শুধু ফ্রেমের জিওমেট্রি WSD। মেয়েদের যাদের বাজেট একটু কম তাদের জন্য হাইলি রেকমেন্ডেড।
স্পেয়ার পার্টস-
এই বাইকের স্পেয়ার প্রতিটি পার্টস ই বাজারে এভেইলেবেল, বিশেষ করে সাইকেল লাইফেই এর স্পেয়ার পার্টস পাবেন।
মেজর কম্পোনেন্ট নিয়ে লেখা শেষ, মাইনর যা আছে সেগুলো প্রাইজ ওয়াইজ “ওকে”।
এই বাইকটি ভি ব্রেক বাইক হিসেবে ডেডিকেটেডলি বানানো যার কারনে ফ্রেমে ডিস্ক ব্রেক লাগানোর অপশন রাখা হয়নি। আপনার যদি একান্তই ডিস্ক ব্রেকের দরকার না হয় তাহলে ভি ব্রেকের বাইক হিসেবে সারাসেন টাফট্র্যাক্স ম্যানস হবে বেস্ট বাইক এট দা মোমেন্ট।
তাছাড়া বাইকের ফ্রেমে ক্যারিয়ার / র্যাক লাগানোর অপশন আছে, আমি র্যাক ইউজ করছি, ম্যাড গার্ড / ফেন্ডার লাগানোর অপশন আছে। বিডিসাইক্লিস্টের বাইক ফ্রাইডে সহ যেকোন লং ডিস্টেন্স (৫০-১৫০কিমি) রাইডের জন্য এই সাইকেল টি গুড এনাফ।
আমার এর চাইতে আরো ভাল স্পেকের বাইক আছে, কিন্তু ওগুলো গ্যারেজে পড়ে ধুলো জমছে, আমি সারাসেন টাফট্র্যাক্স ম্যানস নিয়ে আছি।
বাইকটির কোম্পানি ওয়েব সাইট প্রাইজ ২৯৯ পাউন্ড। বাংলাদেশে এর মূল্য ২৩,০০০ টাকা। এই প্রাইজে এই পারফরম্যান্সের বাইক ঢাকায় খুব কম। অন্তত আমি এটা কনফিডেন্টের সাথে বলতে পারি।
সারাসেনের বাংলাদেশের ডিলার – সাইকেল লাইফ এক্সক্লুসিভ।
ওভার অল আমার রেটিং ১০ এ ৮।
# লিখেছেনঃ
মাইনুল ইসলাম রাহাত
৩’রা ডিসেম্বর, ২০১৪, ঢাকা