[যুক্তরাষ্ট্রের প্রদেশ থেকে প্রদেশে ঘোরা, সাইকেলে। হ্রদ, লোকালয় পেরোনো। উঁচু-নিচু সড়ক ধরে। পথে পথে রোমাঞ্চ ভূপর্যটক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল। তিনি শুনাচ্ছেন তার অসাধারণ কিছু অভিজ্ঞতা ]
ভ্রমণের ডাক যে শুনেছে, তার কি বন্ধ খাঁচা ভালো লাগে? ভ্রমণ এক নেশার মতো। তাই ২২ বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে গেল ছয়টি মহাদেশের ৫৪টি দেশ। লেখা হলো আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে দু’টি বই: ‘সঙ্গী সাইকেল ও আরাধ্য পৃথিবী’ ও ‘এবং পূর্ব আফ্রিকা’। সম্পাদনা করেছি ‘ভ্রমণের খেরো খাতা ও এক্সপেরিয়েন্স বাংলাদেশ’ নামে ভ্রমণ সংকলন।
মানুষ প্রাচীনকাল থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বেড়ানোর বেশির ভাগই কিন্তু কোনো কিছু না ভেবেচিন্তে, উদ্দেশ্যহীনভাবে। ভবঘুরে মানুষ একা একাও ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, বদলে গেছে এই বেড়ানোর ধরন। পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, মোটরসাইকেলে, গাড়ি, বিমান, জাহাজ, ট্রেনে – নানা মাধ্যমে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সময়ের সঙ্গে মানুষের সভ্যতারও বহুমুখী বিকাশ ঘটেছে। উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানোর জায়গায় এসেছে সচেতন ভ্রমন। অজানা-অচেনাকে জানা-চেনার জন্য। ২০০৭ সালে ইমরান একদিন ফোন করে বললো, সে সাইকেলে বিশ্বভ্রমণে যাবে। আমার সাহায্য-সহযোগিতা ও পরামর্শ দরকার। তখন তার সঙ্গে রিফাত এসে যুক্ত হলো। তাদের নিয়ে আমি থাইল্যান্ড পর্যন্ত যাই এবং প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করি। সেখানে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোস্তফা কামালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতার অনুরোধ করি এবং তা তিনি করেন। এখনো সেই ধারা অব্যাহত। তখন ইমরান থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও মিসর ঘুরে আসে এবং তখন আমাদের সঙ্গে আমেরিকান সাইক্লিস্ট, লেখিকা সুজি বেকারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনি বোস্টনে থাকেন এবং প্রতিবছর সাত দিনব্যাপী সাইক্লিং ট্যুরের আয়োজন করেন। ২০০৭ সালেই আমরা তখন পরিকল্পনা করি ‘ক্রস ইউএসএ বাইসাইকেল’ করার। অবশেষে সেটা বাস্তব রূপ নেয় ২০১২ সালের ১১ জুন। আমরা সিয়াটল থেকে ১১ জুন যাত্রা শুরু করি এবং একে একে ১২টি স্টেট ঘুরে ১৪ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে ভ্রমণ শেষ করি ৬৬ দিনে এবং মোট তিন হাজার ৪৬৬ মাইল সাইকেল চালিয়েছি। ১২টি স্টেট হলো: ওয়াশিংটন, আইডাহো, মনটানা, উয়োমিং, সাউথ ডাকোটা, নেব্রাস্কা, আইওয়া, ইলিনয়, ইন্ডিয়ানা, ওহাইও, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ভার্জিনিয়া।
ট্যুরের লক্ষ্য ছিল চলার পথে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়া বা পড়ে থাকা প্লাস্টিক, বোতল, সিগারেটের বাট ইত্যাদি বর্জ্য নিজেদের মোবাইলে এন্ট্রি দেয়া। ইমরান ও এমআইটির যৌথ উদ্যোগে এই অ্যাপটি তৈরি করা হয়েছে। প্রোগ্রামটির নাম ‘ট্রাশ ম্যানিয়াক’, যা অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেমে চলে।
উন্নত বিশ্বের যে দেশগুলোর কনজিউমারিজম এবং অপচয় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, সেগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি। তাই শুরুতে এই দেশকে আমরা বেছে নিয়েছি। এই বার্তা বহন করার জন্য। এই বার্তা যদি মার্কিন নাগরিকদের কাছে পৌঁছায়, তাহলে তারা বুঝতে পারবে, পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষের চিন্তাহীন অপচয়ী জীবনধারার মূল্য অন্য প্রান্তের মানুষদেরও কখনো কখনো দিতে হয়। অথচ এই পুরো পৃথিবীটাই আমাদের সবার। সময় ও সুযোগসন্ধানী মানুষ একে ধীরে ধীরে আলাদা করে ফেলেছে- শিখিয়েছে এটা তাদের, ওটা আমাদের। এটা ইউরোপ, এটা আফ্রিকা, এটা এশিয়া, এটা ধনীদের, ওটা গরিবদের। বিভেদ তৈরি হলো। মানুষ একে অন্যকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করলো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড় প্লাস্টিকের ব্যবহার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। প্লাস্টিকের পণ্য তৈরির পেছনে জ্বালানি প্রয়োজন হয়। তা গ্যাসও হতে পারে। এটি পরিবহনের জন্য জ্বালানি দরকার হয়, পানির প্রয়োজন হয়। ফলে যতো এনার্জি লাগবে, তত বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হবে। কার্বন নির্গমন বাড়লে তা নিচুতে অবস্হিত দেশগুলোর ওপর প্রভাব তৈরি করবে।
আমরা যে বাহনে করে আমেরিকা ঘুরে বেড়িয়েছি, তার নাম ‘ট্যানডেম বাইসাইকেল’। সিয়াটলের ওরেগনে ১৯৯২ সাল থেকে এই সাইকেলগুলো একেবারেই হাতে তৈরি হচ্ছে। এটা বাইক ফ্রাইডের তৈরি ‘কাস্টম ফোল্ডিং অ্যান্ড ট্রাভেল বাইসাইকেল’। এই সাইকেলে একটা সুবিধা হলো, আপনি যেখানেই যান, এটাকে খুলে একটি স্যুটকেস বা বাক্সের ভেতরে নিয়ে যাওয়া যায়। তবে এর দাম বেশি। ‘কাস্টমস মেইড’ বাইকের দাম শুরু হয় ১২০০ ডলার থেকে। এটা এমন এক সাইকেল, যার পেছনে দু’জন বা তার বেশি বসতে চাইলে সেইভাবে বেশি জনের জন্যও বানানো সম্ভব। তবে আমাদের জন্য গর্বের বিষয় ছিল, এ ধরণের ‘ট্যানডেম বাইক’ নিয়ে কেউ ক্রস ইউএসএ সাইক্লিং করেননি। এটা আমাদের জানিয়ে দেন আমেরিকায় সবচেয়ে বড় সাইক্লিং সংগঠন অ্যাডভেঞ্চার সাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশন। তাদের হেড অফিস মনটানাতে যাওয়ার পর সেটা জানতে পেরেছিলাম। এমনকি সেখানে থাকার পর তারা আমাদের ব্যাগেজসহ সাইকেলের ওজন নিলেন এবং জানালেন, এত ওজন নিয়েও কেউ ক্রস ইউএসএ সাইক্লিং করেননি।
আমাদের ক্রস ইউএসএ সাইক্লিংয়ের জন্য ট্রিপের আগেই ম্যাপ করতে হয়েছে। অ্যাডভেঞ্চার সাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশন (এসিএ) সবচেয়ে ভালো ম্যাপ তৈরি করেছে সারা আমেরিকার ওপর। যেহেতু আমরা ওয়েস্ট টু ইস্ট যাচ্ছি, আমাদের সংগ্রহে তাদের সেই ম্যাপ ছিল। যদিও পরবর্তীকালে আমরা ম্যাপটি পুরোপুরি অনুসরণ করিনি। এর জন্য স্হানীয় স্টেটসের ম্যাপ নিতে হয়েছে। যদিও সঙ্গে মোবাইল ছিল এবং মোবাইলের জিপিএস ছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের টি-মোবাইলের নেটওয়ার্ক ওয়েস্ট কোস্টে বেশ সমস্যায় ফেলেছিল। ডেটা সার্ভিস প্রায়শই থাকতো না বা পেতাম না।
আমরা শুরুতে সব সময় ক্যাম্পগ্রাউন্ডে থেকেছি। ন্যাশনাল পার্ক বা স্টেট পার্ক আর বেসরকারি ক্যাম্পগ্রাউন্ডের মধ্যেও। ‘কেওএ’ হচ্ছে সবচেয়ে বড়। সারা আমেরিকায় রয়েছে এদের নেটওয়ার্ক। ডেভ ড্রাম নামের এক ভদ্রলোক এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬২ সালে তিনি বিলিং ও মন্টানাতে এটি শুরু করেন এবং ১৯৬৩ সালে আরও দু’জন পার্টনার নিয়ে এর ফ্র্যাঞ্চাইজিস চালু করেন সারা আমেরিকায়। বর্তমানে ৫০৬টির মতো ‘কেওএ’ রয়েছে। সবচেয়ে বড় ‘কেওএ’ হবে ফ্লোরিডায়। তারপর এমটি রাশমোর, সাউথ ডাকোটায়। ‘কেওএ’তে আরভি সাইটস রয়েছে, কেবিন রয়েছে। সুন্দর শাওয়ার নেবার ব্যবস্হা, বাথরুম এবং অনেক জায়গায় সুইমিং পুলও রয়েছে। ‘কেওএ’র সদস্য হলে ১০% ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়।
সিয়াটল থেকেই আমাদের ক্রস আমেরিকার যাত্রা শুরু। নিউইয়র্ক থেকে দীর্ঘ বিমানযাত্রার পর সিয়াটলে পৌঁছাই। এয়ারপোর্টে আমাদের নিতে এলেন সৈকত। সৈকত মাইক্রোসফটে কর্মরত। জুন মাস, তবু বেশ ঠান্ডা। গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে রাতের সিয়াটল দেখতে দেখতে সৈকতের বাসায় পৌঁছলাম। বাসায় রয়েছে তার ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে ও স্ত্রী। সৈকতও বেশি দিন হয়নি সিয়াটলে এসেছে। ক্লান্ত ছিলাম, তাই খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি।
সকালে নাশতা করে সিয়াটল দেখতে বের হলাম। সাইকেলের এবং ট্যুরের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে একটি সাইকেলের দোকানে যাই। এই অঞ্চল অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য স্বর্গরাজ্য। অ্যাডভেঞ্চার গিয়ারের জন্য বিখ্যাত দোকান হচ্ছে ‘আরইআই’। খুব সুন্দর ও চমৎকার দোকান। আরইআইয়ের সদস্যপদ থাকলে কেনাকাটায় ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। আমেরিকার সবকিছুতেই রয়েছে ব্যবসা। প্রতিটি বড় বড় কোম্পানি বা স্টোরের নিজস্ব সদস্য কার্ড রয়েছে। যেমন- ম্যাকি, গ্যাপ, কস্টকো, অটো জোন, সিয়ারস, ব্যানানা রিপাবলিক ইত্যাদি। আরইআই থেকে কিছু কেনাকাটা করে সিয়াটলের ডাউনটাউন এলাকায় ঘুরলাম। সেখানে বিপুল পর্যটকের সমাগম।
সিয়াটলে রয়েছে অনেক বড় বড় কোম্পানির অফিস, যেগুলোর মধ্যে বোয়িং, মাইক্রোসফট ডাউনটাউনের পাইওনিয়ার স্কয়ার ও পাইক প্লেস মার্কেট দর্শনীয়। এ ছাড়া এখানকার থিয়েটার, মিউজিয়াম এবং পার্ক বিখ্যাত। মিউজিকও। সিয়াটল রক লিজেন্ড জিমি হেনড্রিক্সের জন্মস্হান।
এর আয়তন ৮৩ দশমিক ৯ বর্গমাইল। পাহাড়ি শহর। সাতটি পর্বতের ওপর অবস্হিত। সেঞ্চুরি ২১ এক্সপোজিশন হচ্ছে সিয়াটলের সবচেয়ে বড় ল্যান্ডমার্ক। সৈকত বললো, স্টারবাকস রয়েছে পাইক প্লেস মার্কেটে। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ থেকে এর যাত্রা শুরু হয়ে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কফি কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে এবং বিশ্বের ৬০টি দেশে যার কফি শপ রয়েছে। আমেরিকায় রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার এবং সারা বিশ্বে রয়েছে ১৯ হাজার ৯৭২টি। প্রথমে এটি তিনজন পার্টনার নিয়ে যাত্রা শুরু করে। তাঁরা হচ্ছেন- ইংরেজি শিক্ষক জেরি বাল্ডউইন, ইতিহাসের শিক্ষক জেভ সেগল এবং লেখক গর্ডন বাউকার।
১১ জুন। আমাদের যাত্রার শুরুর দিন। ট্যানডেম সাইকেল কখনো চালাইনি। ইমরান চালকের আসনে আর আমি পেছনে। আমাকে তার সঙ্গে পা চালাতে হবে একই গতিতে। সে থামালে আমাকেও থামাতে হবে। সে দ্রুত পা চালালে আমাকেও দ্রুত চালাতে হবে। আমার কোনো স্বাধীনতা নেই। এটা সহজ কাজ নয়। নিজের বিশ্রাম, প্রস্রাব করা, পানি খাওয়া- সবই নির্ভর করতে হতো তার ওপর। ব্যাপারটা কখনোই উপভোগ্য ছিল না।
আর যেহেতু ট্যানডেমে আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, একটা অজানা ভয়ও কাজ করছিল। শরীরও বেশ ভারী। ওজন ৭০ কেজি। লেকের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি। খুব সুন্দর ও নিরিবিলি। লেক পার হয়ে শহরের ব্যস্ত রাস্তায় এসে পড়লাম এবং হাইওয়েতে ওঠার আগে বেশ সময় লাগলো রাস্তা খুঁজে পেতে। হাইওয়েতে সাইকেল চালাতে পারবো কি না- এই দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। ‘আই-৯০’ বেশ বড় ও বিখ্যাত হাইওয়ে। তাতে সাইকেল চালানোর জন্য বেশ বড় স্পেস বা বাইক লেন ছিল; কিন্তু যেসব বড় বড় লরি, ট্রাক দ্রুত গতিতে যাচ্ছিল বলে সব সময় সাবধানে থাকতে হতো। বড় গাড়ির বাতাসের ধাক্কা সামলানো বেশ কঠিন। একটু অসাবধান হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা হতে পারে। পথে মাঝেমধ্যে থেমে বিশ্রাম নিয়ে ও হালকা খাবার খেয়ে পা চালাচ্ছি, ছবি তুলছি। সমতল ভূমি থেকে বেশ উচ্চতায় হাইওয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠতে লাগলো আর যন্ত্রণাও বাড়তে থাকলো। উচ্চতায় আমার শ্বাসকষ্ট ও পিপাসা পায়। হালকা শীত রয়েছে। ফলে কিছুটা হলেও আরামে আছি। ঘাম হচ্ছে না, তবে আমার মোবাইলে জিপিএসের কারণে ঘাম এসে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই জিপিএসের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। আর এটা এমন জায়গা, যেখানে লোকজনের দেখা নেই। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবো, সে উপায়ও নেই। দু’একটি জায়গায় লোকজনের দেখার জন্য বা ডিরেকশন জানার জন্য বেশ কয়েকটি বাসা/ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গেলাম ভীরু পায়ে। কারণ, আমেরিকায় বিনা অনুমতিতে কারও জায়গায় যাওয়া নিষেধ। তার ওপর রয়েছে ‘বিওয়্যার অব ডগ’ বা ‘নো ট্রেসপাসিং সাইন’।
প্রথম দিন যে ক্যাম্পগ্রাউন্ডের ঠিকানা আমাদের কাছে ছিলো, সেখানে যেতে যেতে বিকেল হয়ে গেল; কিন্তু সেটা ছিল ব্যক্তিগত। সেখানকার লোকজন আমাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন, ঠান্ডা পানি পান করালেন এবং নিকটবর্তী ক্যাম্পগ্রাউন্ডের ঠিকানা বাতলে দিলেন। প্রথম দিনের ক্যাম্পগ্রাউন্ডটি ছিল একটি স্টেট পার্ক। যদিও অনেক বেগ পেতে হয়েছে খুঁজে বের করতে। ক্যাম্পে যাওয়ার পর সেখানে দায়িত্বে থাকা লোকটি বললো, তোমরা যেখানে খুশি ক্যাম্প করতে পারো। ভাড়া খুব কম। একটি বিশেষ জায়গায় এমনভাবে তাদের ডিসপ্লে রয়েছে, যেখানে এসে যে কেউ ফরম ফিলাপ করে সেখানেই টাকা জমা দিতে পারবে। একটি নির্দিষ্ট ড্রপ বক্সে। তাঁবু টানানো হলো। এবার রান্নার জন্য চুলা বানিয়ে নুডলস ও সকালের নাশতার জন্য সেমাই রান্না করা হলো। পেট পুরে খেলাম। ১০ ঘণ্টারও বেশি সাইকেল চালিয়েছি। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। কিন্তু আশাবাদী।
সাইকেল চালানো ছাড়াও আমাদের এই অ্যাডভেঞ্চারের আরেকটা লক্ষ্য ছিল রাস্তায় যেসব প্লাস্টিকের তৈরি জিনিস যেমন পানির বোতল, খাবারের মোড়ক, ক্যান, কাচের বোতল অথবা এমন কিছু যা মাটিতে মিশতে বহুদিন লেগে যায়, তেমন কিছু যদি পাওয়া বা দেখা যায়, তা গণনা করা। মোবাইলের মাধ্যমে। ইমরানের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) বন্ধুরা একটি বিশেষ প্ল্যাটফর্ম অ্যাপ্লিকেশন বানিয়ে দিয়েছিল আমাদের। রাস্তায় কোনো প্লাস্টিকের তৈরি জিনিস দেখামাত্র আমরা তার এন্ট্রি দিতাম আর তখন তা গুগল ম্যাপের মাধ্যমে আমাদের ওয়েবসাইটে চলে আসতো।
প্রতিদিন খুব ভোরে উঠতে হতো। পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠে তাঁবু গুটিয়ে হালকা নাশতা করেই রওনা দিতাম। যদিও সঙ্গে হালকা খাবার হিসেবে খেজুর, এনার্জি বার ইত্যাদি থাকতো এবং চা-কফির জন্য পথে যে গ্যাসস্টেশন বা গ্রোসারির দোকান পড়তো, সেখানে যাত্রাবিরতি দিয়ে হালকা নাশতা করে নিতাম। সেই সঙ্গে খানিক রেস্টও হয়ে যেতো আমাদের।
দ্বিতীয় দিনের যাত্রা ছিল আয়রন হার্ন ট্রেইলের ভেতর দিয়ে। পাথুরে রাস্তা। বেশ কষ্টকর। ঠিকমতো বসতে কষ্ট হতো। একদিকে সাইকেলের ওজন এবং অন্যদিকে ধীর গতিতে চালানো। তবে একটা ভালো দিক ছিল, দু’পাশে প্রচুর গাছ, হালকা নরম রোদ, মাঝে মাঝে ছবি তোলার জন্য থামতে হতো। তখন বেশ ভালো লাগতো। বিকেলে ‘ঈগল ভ্যালি’ নামে এক জায়গায় ক্যাম্প করলাম। ঈগল ভ্যালি খুবই সুন্দর। পুরো ভ্যালিতে আমরা দু’জনই ছিলাম। তাদের শাওয়ার ও রেস্টরুম চমৎকার। ভাড়াও ছিল অসম্ভব কম। সেখানকার কেয়ারটেকার আমাদের বেশ খাতির করলেন এবং খাওয়ালেন। পরদিন আবার ট্রন হর্স ট্রেইল ধরে যাত্রা শুরু। কাঁচা রাস্তা, শূন্য চারদিক। এর মাঝে আমরা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি। এদিন ইমরানের দামি জ্যাকেটটি সাইকেল থেকে কখন যে পড়ে যায়, তা টের পেলাম না। তার মন খারাপ আর আমি বাকরুদ্ধ।
ঈগল ভ্যালি থেকে আমরা কলম্বিয়া রিভারের কাছে ভিন্টেজ ক্যাম্পগ্রাউন্ডে এসে পৌঁছাই। বেশ বাতাস। ক্যাম্পগ্রাউন্ডটি নদীর পাশে। বাতাস থাকায় বেশ কষ্ট করে রান্না করতে হলো। সেখানে অল্প কয়েকজন সাইক্লিস্টের কথা জানতে পারলাম। তারা বেশ বড় গ্রুপ এসেছে এবং সকালে তারা এই স্হান ছেড়ে গেছে। এখানকার রাস্তাঘাট বেশ উন্নত। দু-একটি দোকানপাটও রয়েছে। ক্যাম্পগ্রাউন্ড থেকে আলাদা জায়গায় রয়েছে গোসলখানা ও বাথরুম। গোসল করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।
সকালে রওনা হই। গত রাতে ডেভিডের ই-মেইল এলো। ভিন্টেজ ক্যাম্পগ্রাউন্ডের সামনে কলম্বিয়া নদীর ওপর একটি সেতু রয়েছে, যা ১৯২৭ সালে উন্মুক্ত হয়। সানসেট হাইওয়ের সঙ্গে এটি যুক্ত। যা বর্তমানে আই-৯০ হাইওয়ে নামে পরিচিত।
ভিন্টেজে রক ক্লাইম্বিং করার জন্য অনেক পর্যটক আসেন। জিপিএস ধরে এগোতে থাকি এবং ১০ মাইল সাইকেল চালানোর পর একটি ডেড এন্ডে চলে আসি। বুঝতে পারি, আমরা ভুল পথে এসেছি। আবার উল্টো পথে রওনা হয়ে ভিন্টেজের দিকে এলাম। ভুল রাস্তা হলেও তাতে সাইকেল চালাতে বেশ ভালো লাগছিল। কলম্বিয়া নদীর পাশ ধরে উঁচু-নিচু চমৎকার রাস্তা আমাদের ক্লান্তি দূর করে দেয়। তারপর ২০ মাইল চালিয়ে আবার ক্যাম্পের পাশের সেই ব্রিজ পার হয়ে মাতওয়ার পথে সাইকেল চালাচ্ছি। পথে এক জায়গায় দেখলাম, কিছু মেক্সিকান গাছ থেকে চেরি ফল পাড়ছে। আমি কিছুটা স্প্যানিশ জানি। “বুয়েনস, দিয়াস ওলা আমিগো” বলে কথা শুরু করলাম। এবং তাদের অনুমতি নিয়ে অনেক চেরি ফল খেয়ে সঙ্গে নিয়ে নিলাম, যা আমাদের চলার পথে বেশ কাজে এসেছে এবং ব্যাপারটা আমরা বেশ উপভোগ করেছি।
সুন্দর রাস্তা। সাইকেল চালাতে ভালোই লাগছে। মাতওয়া শহরে যখন পৌঁছলাম, তখন অনেক মেক্সিকান এখানে দেখলাম। রাস্তার পাশে প্রচুর পেঁয়াজ, বিয়ারের খালি বোতল পড়ে আছে। রাস্তার দু’পাশে প্রচুর শস্যক্ষেত ও ফলের গাছ। ভুট্টা ও আপেল গাছ প্রচুর। মাতওয়া থেকে ওথেলো যাওয়ার পথের ডিরেকশন জানার জন্য তিন রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছি। কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মাঝে মাঝে জিপিএসের নেটওয়ার্ক কাজ করে না। কখনো মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকে না। টি-মোবাইলের সার্ভিস এই পশ্চিমের জায়গাগুলোতে বেশির ভাগ এলাকাতেই পাইনি। পথের দিকনির্দেশনার জন্য সাইকেল থামিয়ে অপেক্ষা। হঠাৎ একটি গাড়ি আসায় হাত দিয়ে ইশারা করতেই পাশে থামালো। গাড়িতে দুজন। একজন আমেরিকান অন্যজন ভিনদেশি। ওথেলো যাওয়ার রাস্তা কোন দিকে, জানতে চাইলাম। উত্তরে যা বললো, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পরিবর্তে সে উল্টো আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কোন ধর্মের? আমি মুসলমান কি না? তার জিজ্ঞাসার সুর আক্রমণাত্মক ছিল। বললাম, “আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, তার উত্তর এটি নয়।” ওদিকে গাড়িতে বসা মহিলাটি লোকটিকে উত্তর দেয়ার জন্য অনুরোধ করলো এবং আমার মনে হলো মহিলাটিও লোকটির আচরণে লজ্জিত ও বিরক্ত। লোকটি যত বেশি উত্তেজিত, আমি ততো বেশি ঠান্ডা। কারণ আমি জানি, “কিছু নেই উত্তেজনায়, কিছু নেই ঘৃণায়”।
একজন পর্যটকের সঙ্গে বিদেশের মাটিতে কখনোই ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে তর্কে লিপ্ত হতে নেই। একজন রোটারিয়ান হিসেবেও জানি ‘রাগলেন তো হারলেন’।
লোকটি আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। আমি তাকে বললাম, “থ্যাংক য়ু ফর ইউর টাইম”। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কিছু মেক্সিকান লোক রাস্তা বলে দিলো। আমরা সেই পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। তখনো জানতাম না সামনে আরও ভয়ানক কিছু অপেক্ষা করছে। দুপুর; তাই গতিও মন্হর। খাওয়ার পানিও শেষ পর্যায়ে অথচ চারপাশে কোনো দোকানপাট নেই, মানুষের বসতবাড়িও চোখে পড়ছে না। পা চালাচ্ছি আর ভাবছি, সামনে যেখানেই থাকার জায়গা পাবো সেখানেই থেকে যাবো; কিন্তু বিধি বাম, তেমন কোনো কিছুরই দেখা নেই। এক চার্চ দেখে থামলাম, সাহস করে চার্চে ঢুকলাম, যদিও সেটা চার্চের পাশের অফিস ছিল। সেখানে অনেক ডাকাডাকি হলো, খোঁজ হলো। কিন্তু সেখানেও কাউকে পেলাম না। যার কাছ থেকে সামনে থাকার জায়গা বা পানি নিতে পারবো। কোনোটাই হলো না। পানির সন্ধান না পাওয়ায় সেখানে থাকার পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো। কিছু দূর সাইকেল চালানোর পর রাস্তার পাশে একটি আরভি গাড়ি দেখে দ্রুত সেখানে যাই এবং জানতে পারি, ওথেলো শহরের আগে ক্যাম্প করার কোনো জায়গা নেই এবং সেখানে যেতে আরও চার-পাঁচ ঘণ্টা সাইকেল চালাতে হবে। তাও আবার পানি ছাড়া! কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। আস্তে আস্তে জনমানবহীন রাস্তায় চলে এলাম। মাঝে মাঝে দূর থেকে বাড়িঘর দেখতে পেয়ে খুশিতে দ্রুত পা পড়লো। কিন্তু সেও এক মরীচিকা। দূর থেকে বাড়িটি যতোই কাছে দেখা যাচ্ছে, বাস্তবে তার উল্টো। পথের ধারে কিছু ঘর দেখতে পেয়ে যতবারই থেমেছি, ততোবারই নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছি পানি না পেয়ে। একপর্যায়ে রাস্তার পাশে খাল দেখতে পেয়ে থামলাম পানির জন্য। বোতলে দড়ি বেঁধে পানি আনলাম। খালের পানি দিয়েই হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। ক্লান্তি কিছুটা দূর হলো। বিপদ যখন আসে, তখন সব একত্রে আসে। হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। দ্রুত পা চালালাম। অবশেষে রাত ১০টার পরে ওথেলো শহরে এসে পৌঁছাই। একটি গ্যাস স্টেশনে থামলাম। কিন্তু বিধি বাম, গ্যাস স্টেশনে কর্মরত মেয়েটি বললো, দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, সে তাই দরজা খুলবে না। কিছু দূর যাওয়ার পর কয়েকটি খাবার দোকান দেখতে পেলাম। বার্গার কিংয়ে ঢুকে গেলাম। ঘড়িতে তখন রাত ১০টার বেশি বাজে। তারাও দোকান বন্ধ করে দেবে; কিন্তু আমাদের অবস্হা দেখে বললো, তোমরা আরাম করে খাও। কোনো সমস্যা নেই। পেট পুরে খেলাম। তাদের কাছ থেকে সস্তায় থাকা যায়, এমন একটি মোটেলের খোঁজ নিলাম পরে তাদের দু’জন এসে দেখে যায়, আমরা মোটেলে ঠিকমতো পৌঁছতে পেরেছি কি না। বার্গার কিংয়ে কর্মরত সবাই ছিল তরুণ-তরুণী। অর্ধেকের বেশি ছিল মেক্সিকান। “মুচাস গ্রাসিয়াস” বলে বিদায় জানালাম। মোটেলের দায়িত্বে থাকা লোকটি জানালো, মোটেলটির মালিক একজন পাকিস্তানি। সকাল থেকে ৮৩ মাইল সাইকেল চালিয়েছি এবং এটি ছিল ভ্রমণজীবনের একটি স্মরণীয় দিন।
সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠলাম। এবারের গন্তব্য মোজেস লেক, যা ওথেলো থেকে ৩১ মাইল দূরে। ওথেলো থেকে রওনা হলাম ধীরেসুস্হে। চারপাশে সবুজের সমারোহ। আধুনিক পদ্ধতিতে ক্ষেতে পানি দেয়া হচ্ছে। দুপুরের দিকেই মোজেস লেকে পৌঁছে যাই। ব্যাংক অব আমেরিকায় গিয়ে কিছু টাকা তুলে নিই। ক্যাম্পগ্রাউন্ড যাওয়ার রাস্তাও জেনে নিই। ক্যাম্পগ্রাউন্ডটি অসাধারণ এক জায়গায় অবস্হিত। পাশে সুন্দর লেক। অনেকে মাছ ধরছে। স্পিডবোট চালাচ্ছে কেউ কেউ। লেকের পাশে গাছের নিচে তাঁবু টানালাম। কনক আদিত্য, ‘জলের রং’ ব্যান্ডের সদস্য। ‘দেশালে’র কর্ণধার। ইউএসএতে আছেন। তার সঙ্গে কথা হলো এবং তাকে বললাম, তার গান আমরা সাইকেল চালানোর সময় শুনি।
এই ক্যাম্পগ্রাউন্ডে অনেকে তার পরিবার-পরিজনসহ এসেছেন। বচ্চারা খেলাধুলা করছে, মাছ ধরছে, লেকের পানিতে সাঁতার কাটছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। আহা, কী মজা! যানজট নেই, কোলাহল নেই, ঘরে ফেরার তাড়া নেই। কারণ, তারা পরিবারের সঙ্গে এখানেই তাঁবুতে রাত যাপন করবেন।
সাইকেল খুলে দু’জনে মিলে সাইকেল পরিষ্কার করে নিলাম। প্রতিদিনই আমাদের চেষ্টা থাকে সাইকেলের যত্ন নেবার। ক্যাম্পের কাছেই দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করলাম। ইমরান খুব ভালো রান্না করে। পেট পুরে খেয়ে ঘুম।
মোজেস লেক থেকে ভোরে রওনা হলাম। গন্তব্য রিগভিল, যা প্রায় ৪০ মাইল দূরে। কিছু দূর চালানোর পর টের পেলাম এই রাস্তার আশপাশে বিরান জমি ও ফসলের ক্ষেত। পানি পেলাম পথেই। বেশ গরম পড়েছে। পিপাসা মেটাতে একটু পর পর পানি পান করলাম, তবু শরীর নেতিয়ে পড়েছে। প্রায় দুই ঘণ্টা সাইকেলও ঠেলতে হয়েছে। পথ উঁচু-নিচু বলে। চারটার দিকে রিগভিল শহরে পৌঁছলাম। বেশ পুরনো শহর। সেখানকার ডাউনটাউন এলাকায় যাই এবং একটি চায়নিজ গ্রোসারির দোকান থেকে কলা, কেক ও এনার্জি পানীয় ‘মনস্টার’ কিনলাম। পুরো জার্নিতে আমরা প্রতিদিনই পান করতাম। মনস্টার ছিল আমাদের বিশেষ বা পরম পছন্দের পানীয়, যা খেয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙা হতাম। পুলিশের গাড়ি দেখে তার কাছ থেকে ঠিকানা জেনে নিই। গন্তব্য ফোর সিজন ক্যাম্পগ্রাউন্ড। সেখানে ঢোকার রাস্তাটি ছিল বেশ কঠিন। কাঁচা আর পাথুরে রাস্তা। তবে চারদিকে সবুজের বিশাল সমারোহ, যা আমাদের মুগ্ধ করে। ক্যাম্পগ্রাউন্ডে পৌঁছাই সন্ধ্যার সময়। সেখানে আরও পাঁচ-ছয়টি আরভি রয়েছে। এরউইন নামের এক লোকের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি ও তার স্ত্রী আরভিতে উঠেছেন। রাতের খাবার তারা তৈরি করছিলেন এবং আমাদের মুরগির মাংস ও শিম দিলেন। আমি তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে আনা আচার দিলাম। পাশের আরভির আরেক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হলো এবং আমার মোবাইলে চার্জ দিলাম তার আরভি থেকে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তাই আজ আর রান্না করা হলো না। এরউইনের দেয়া খাবারই আমরা দু’জন ভাগ করে খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
ফোর সিজন ক্যাম্পগ্রাউন্ড থেকে সকালে রওনা হই চেনয়ের উদ্দেশে। ৩৭ মাইলের পথ। ডেভিডের বাসায় উঠবো। ডেভিড আমাদের সাইক্লিস্ট বন্ধু রিক গানের বন্ধু। অল্প কিছু রাস্তা ছিল কাঁচা এবং বাকিটুকু ভালো। তবে গ্রেভেল রোডে উঠলে ঝাঁকিতে বসা যেতো না। পাছায় ব্যথা হতো। দুপুরে ডেভিডের সঙ্গে কথা হলো এবং তার বাসার ঠিকানা ধরে এগিয়ে চললাম। পথে এক জায়গায় গাছের সঙ্গে সাইনবোর্ড ঝুলছে- ‘ক্যাট ক্রসিং’। আজ ফাদারস ডে। ডেভিড তার মেয়ের বাসায় যাবে আমাদের নিয়ে। ১৫ একর জায়গা নিয়ে ডেভিডের বাড়ি। থাকে শুধু স্বামী-স্ত্রী। ডেভিডের বয়স ৬৮। বেশ সুন্দর বাড়ি। বিশাল কিচেন। ডেভিড তার কিচেন দেখিয়ে বললো, “তোমরা নিজের মতো করে ব্যবহার করো।” আমরা ভাত বসালাম এবং ডিম ভাজি করে ভাত খেলাম। ট্যুরের প্রথম ভাত। মনে হলো কতো দিন ভাত খাইনি! ডেভিড আমাদের কাপড় দিয়ে দিল ওয়াশিং মেশিনে। বিকেলে তার মেয়ের বাসায় রওনা হলাম চারজনে। যাবার পথটি ছিল খুবই চমৎকার। উঁচু-নিচু রাস্তার পর বিশাল সবুজের সমারোহ। হরিণের দেখাও পেলাম। ডেভিডের মেয়ের বাসায় পৌঁছলাম। ডেভিড কিছু ওয়াইন নিলো তার মেয়ে ও মেয়ের জামাইয়ের জন্য। মেয়ের জামাই শিকারি। তাদের তিন কন্যাসন্তান রয়েছে। আমরা একত্রে ডিনার করে তার বাসা ঘুরে দেখলাম। ব্রায়ান তার শিকার করা বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া একটি রুমে সাজিয়ে রেখেছে। আমাদের নিয়ে বন্দুক, পিস্তল দিয়ে শেখালো কীভাবে গুলি করতে হয়, লক্ষ্য ভেদ করতে হয়। কান ফেটে যাওয়ার দশা। তাই কানে এয়ার প্লাগ দিলো। ব্রায়ান প্রায়শই শিকার করার জন্য আইডাথে, মনটানাতে যায়। সে ভালুকও শিকার করেছে। তার আলাস্কার গল্পও শোনালো।
রাতে বাসায় এসে ই-মেইল চেক করলাম। কানাডার বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে রাহাত বিন জামান মেইল করেছে। সে মেক্সিকোর বাংলাদেশি লোকদের কিছু ঠিকানা চাইলো। রাহাতকে তা দিয়ে দিলাম। বাংলাদেশ সরকার ব্রাজিল ও মেক্সিকোতে দূতাবাস খোলার চেষ্টা করছে। তবে ব্রাজিল, মেক্সিকোর পাশাপাশি পানামা ও মেক্সিকোতে আমাদের দূতাবাস খোলা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে যাদের এখানে পোস্টিং হবে তাদেরকে পর্তুগিজ (ব্রাজিলের জন্য) এবং স্প্যানিশ শিখে আসা উচিত। ১২টি দেশ, সেন্ট্রাল বা মধ্য আমেরিকার সাতটি দেশে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। ব্যবসা, পর্যটন, শিক্ষা, সংস্কৃতি। ২০১৪তে বিশ্বকাপ ফুটবল এবং ২০১৬তে অলিম্পিক গেমস ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হবে। অর্থনৈতিকভাবে ব্রাজিল বিশ্বের শক্তিশালী একটি দেশ। ল্যাটিন আমেরিকায় এখনো বাংলাদেশি লোকজন সেইভাবে বসতি স্হাপন করেনি। তবে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও প্যারাগুয়েতে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি রয়েছে। নিউইয়র্কে একবার ব্রাজিলের মিনিস্টার অব স্টেট জর্জ হেগ সবরিনহোর কথা হয়েছিল। তিনি আমাকে সে দেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। ব্রাজিলসহ অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। পর্যটন ও কৃষি খাতে সুযোগ কম নয়। বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু ওষুধ কোম্পানির ওষুধ ল্যাটিন ও সেন্ট্রাল আমেরিকায় যাচ্ছে।
ডেভিড শোবার কামরা দেখিয়ে দিলো এবং আমরা রুমে এসে নিজেদের তোলা ছবিগুলো ফেসবুক আর আমাদের ওয়েবসাইট ও ফ্লিকার অ্যাকাউন্টে আপলোড করলাম। তাঁবু ছেড়ে অনেক দিন পর বিছানায় ঘুমাতে পারলাম।
# কৃতজ্ঞতাঃ
১। আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল
২। অযান্ত্রিক
৩। গুগল