চট্টগ্রামের দুই তরুণ এ আর বাবুল এবং নোমান সিদ্দিক। ২৯ দিন সাইকেল চালিয়ে ঘুরেছেন সারা বাংলাদেশ। সাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় মানুষকে করেছেন সচেতন। উদ্যমী দুই তরুণকে নিয়ে প্রচ্ছদ লিখেছেন নাদিম মজিদ।
পুরো নাম আবদুর রহমান বাবুল। বন্ধুদের কাছে পরিচিত এ আর বাবুল নামে। সাইকেল চালানো শিখেছিলেন ছোটবেলায়। তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়তেন। থাকতেন চট্টগ্রামের শান্তিনগরে। সেখানে কয়েকটি দোকান ঘণ্টা হিসেবে সাইকেল ভাড়া দিত। ঘণ্টায় পাঁচ টাকা। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সে সময় সাইকেল চালানো শিখেছিলেন বাবুল। সাইক্লিং শখ হিসেবে নিয়েছেন ২০১৪ সালের মে মাসে।
মে মাসের এক শুক্রবার ৭০ জনের দল নিয়ে চট্টগ্রামের ওয়াসা মোড় থেকে আগ্রাবাদ হয়ে জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে হাজির হয়েছিলেন। একসঙ্গে এত তরুণ সাইকেল চালাচ্ছে দেখে মন ভালো হয়ে যায়। পাশাপাশি শরীর ভালো থাকা, মন প্রফুল্ল থাকা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার বিষয়টি তাকে সাইক্লিংয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এক সময় যোগ দেন সাইক্লিং সংগঠন দ্বিচক্রযানে। এখানে পরিচয় হয় আরও দুই তরুণ- সাদাব ইয়াসির এবং নোমান সিদ্দিকের সঙ্গে। তার পরের শুক্রবারগুলো অন্যরকম হয়ে ওঠে। প্রায় প্রতি শুক্রবারই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। একেক দিন চট্টগ্রাম থেকে ফেনী, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং রাঙামাটিতে চলে যান। দিনে দিনে ঘুরে আবার চলে আসেন। প্রতিবেশী জেলাগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাদের মুগ্ধ করতে থাকে। ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো তাদের টানে। এভাবে কিছুদিন যেতেই মাথায় আসে, পাশের জেলাগুলো এত সুন্দর- সারাদেশেও এমন সুন্দর এবং ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে নিশ্চয়। এর পরই মাথায় ঢুকল ৬৪ জেলা ভ্রমণের চিন্তা।
তিনজনের মাঝে সিনিয়র সাদাব ইয়াসির। চট্টগ্রাম ছাড়াও বিভিন্ন জেলার সাইকেল সংগঠনের সঙ্গে তার পরিচয় রয়েছে। বিভিন্ন জেলার সাইক্লিস্টদের সঙ্গে কথা বলেন। সাইকেলে দেশ ভ্রমণের নকশা করেন তিনি। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় যাত্রা। শেষ হয় ২১ মার্চ। চট্টগ্রাম থেকে ফেনী হয়ে সমগ্র বাংলাদেশ। শেষ হয় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। পথে পথে অম্লমধুর অভিজ্ঞতা। প্রতিদিন ১৪০ কিলোমিটার থেকে ১৮০ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হয়েছে। বেশি সমস্যা হয়েছে মহাসড়কগুলোতে। তারা রাস্তার একপাশ দিয়ে চলতেন। পাশ দিয়ে যখন বাস বা ট্রাক যেত, সঙ্গে থাকত প্রচণ্ড বাতাস। বাতাসের মাঝে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ ছিল। জেলা থেকে জেলায় যাওয়ার নকশা আগে থেকেই করা ছিল। সাইক্লিস্টরা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। অনেক সময় তাদের বাড়িতে ছিলেন। কখনও ছিলেন হোটেলে। চলার পথে কোনো স্কুলের সন্ধান পেলে সেখানে থেমে যেতেন। ছাত্রছাত্রীদের সাইক্লিংয়ের উপকারিতা বোঝাতেন। চলার পথে নতুন কোনো জনপদে থামলে নতুন আগন্তুক সম্পর্কে এলাকাবাসী জানতে চাইত। জনগণের মাঝে যানবাহনের কালো ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশ রক্ষায়, শারীরিক সুস্থতায় সাইক্লিংয়ের উপকারিতা তুলে ধরতেন বাবুল, নোমান ও সাদাব।
২৭টি জেলা ভ্রমণের পর সাদাব ইয়াসিরের কাছে টেলিফোন আসে বাড়ি থেকে। বাবা অসুস্থ। বাড়িতে ফিরতে হবে। তারা তখন বগুড়ায়। সাদাব দলটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সাদাবের ফিরে যাওয়া জরুরি হয়ে পড়ায় টেনশনে পড়ে যান বাকি দুই সদস্য এ আর বাবুল এবং নোমান সিদ্দিক। আশ্বস্ত করেন সাদাব। ‘আমি তোমাদের রোডম্যাপ বুঝিয়ে দিচ্ছি। কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবে। ২৭টি জেলা পার হয়ে এসেছি। বাকি জেলাগুলোও পারবে। ৬৪টি জেলা ঘুরেই তোমাদের ফিরে যাওয়া উচিত।’
এবার দু’জনের যাত্রা। মনের ভেতর নিজের দেশকে এক ভ্রমণেই দেখার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। তাই পেছনে ফিরতে হয়নি। দর্শনীয় স্থানে গিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে দেন। তুলে ধরেন প্রিয় দেশকে। প্রথম কয়েক দিন বিভিন্ন সাইক্লিস্টের বাসায় বা হোটেলে থাকতে হয়েছিল। ৩০টি জেলা ভ্রমণের পর জেলা প্রশাসকরা তাদের থাকার ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। নামমাত্র ভাড়া দিয়ে সার্কিট হাউস এবং সরকারি রেস্ট হাউসে থাকার সুবিধা পান ওরা। অবিরাম সাইকেল চালিয়েছেন। পথে পথে বিভিন্ন জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোতে হাজির হয়েছেন। খেয়েছেন বিভিন্ন অঞ্চলের খাবার। দলের সদস্য নোমান সিদ্দিক বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশ দেখা, দেশকে জানা। যে জেলায় গিয়েছি, কমপক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দেখেছি। যেসব জেলায় উল্লেখযোগ্য খাবার রয়েছে, তার স্বাদ নিয়েছি। কুমিল্লার ময়নামতি বৌদ্ধবিহার, বগুড়ার মহাস্থানগড়, দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে শুরু করে নড়াইলে মাশরাফি বিন মুর্তজার বাড়ি কোনোটাই মিস করিনি। মৌলভীবাজারের সাত রঙের চা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, নওগাঁর মান্দার সন্দেশ, রাজশাহীর কালাইরুটি, নাটোরের কাঁচাগোল্লা প্রভৃতির স্বাদ চেখে দেখেছি। পাশাপাশি মানুষের মাঝে দেশকে জানা এবং পরিবেশ রক্ষায় সাইক্লিংয়ের ভূমিকার কথা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
সাইকেল নিয়ে একটি মজার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে এ আর বাবুল বলেন, ‘টাঙ্গাইলের রাস্তার কিছু অংশ খুবই খারাপ। ভাঙা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেতে কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু পোড়াবাড়ির চমচম খেয়ে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল। তাই এইটুকু কষ্ট হাসিমুখে মেনে নিয়েছি।’
নোমান সিদ্দিক বলেন, ‘সাইকেল চালিয়ে ফরিদপুরের নগরকান্দায় যখন পেঁৗছাই, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সাইকেলে লাইট জ্বালানোর জন্য একটি বাজারে থামলাম। ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ আমাদের দেখে বলেন, তোমরা কী বিক্রি করতে এসেছ? এখন তো রাত হয়ে গেছে। কিছু বিক্রি করতে পারবে না। আমরা তাকে পরিচয় দিলে তিনি অবাক হয়ে যান।’
২৯ দিনে দেশভ্রমণ করতে পেরে খুশি দু’জনই। এ আর বাবুল বলেন, ‘একসঙ্গে দেশ দেখার মজাই আলাদা। সাদাব ইয়াসির ভাই থাকলে আরও ভালো লাগত। তবে কষ্টটা খানিকটা ভুলতে পেরেছি নিজের দেশটা দেখতে পেরে। আমাদের দেশটা সত্যি অনেক সুন্দর।’
# কৃতজ্ঞতাঃ
১। দৈনিক সমকাল
২। নাদিম মজিদ